সরাসরি শিরক কিংবা শিরকের মাধ্যম

মানব সমাজে এমন অনেক বিষয় রয়েছে, যা কখনো বড় শিরক আবার কখনো ছোট শির্কে পরিণত হয়। মানুষের অন্তরের অবস্থা ভেদে তা থেকে যেসব কথা ও কাজ প্রকাশিত হয়, সে অনুপাতেই এগুলো কখনো বড় শিরক আবার কখনো ছোট শির্কে পরিণত হয়। অনেক মানুষ এতে আক্রান্ত হচ্ছে। এগুলো কখনো আকীদার পরিপন্থী হয় আবার কখনো আকীদার পরিচ্ছন্নতাকে ঘোলাটে করে ফেলে। সাধারণ জনগণের মধ্যে এগুলোর চর্চা ব্যাপকভাবে হয়ে থাকে। মূর্খ লোকেরা মিথ্যুক, চালবাজ, ফাঁকিবাজ ও ভেলকিবাজদের খপ্পরে পড়ে এসবের শিকার হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এগুলো থেকে মুসলিমদেরকে সাবধান করেছেন।

أولا: لبس الحلقة والخيط ونحوهما بقصد رفع البلاء أو دفعه – প্রথমত: রোগ-ব্যাধি ও বিপদাপদ দূর করা অথবা প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে আংটি, তাগা, সূতা ইত্যাদি পরিধান করা

এগুলো জাহেলী যুগের কাজ। এগুলো পরিধান করা ছোট শিরকের অন্তর্ভুক্ত। তবে এগুলো পরিধানকারীদের অন্তরের অবস্থা ও আকীদা অনুপাতে বড় শিরকের স্তরে পৌঁছতে পারে। সাহাবী ইমরান ইবনে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,

أن النبي صلى الله صلى الله عليه وسلم رَأَى رَجُلاً فِى يَدِهِ حَلْقَةٌ مِنْ صُفْرٍ فَقَالَ مَا هَذِهِ الْحَلْقَةُ قَالَ هَذِهِ مِنَ الْوَاهِنَةِ قَالَ انْزِعْهَا فَإِنَّهَا لاَ تَزِيدُكَ إِلاَّ وَهْنًا

‘‘নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তির হাতে পিতলের একটি বালা দেখলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কি?’’ লোকটি বললো, এটা দুর্বলতা দূর করার জন্য পরিধান করা হয়েছে। তিনি বললেন, এটা খুলে ফেল। কারণ এটা তোমার দুর্বলতাকে আরো বৃদ্ধি করবে। আর এটা তোমার সাথে থাকা অবস্থায় যদি তোমার মৃত্যু হয়, তাহলে তুমি কখনো সফলকাম হতে পারবে না’’।[1]

ইমাম আহমাদ ইবনে হান্বাল রহিমাহুল্লাহ ত্রুটিমূক্ত সনদে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম ইবনে হিববান ও হাকেম সহীহ বলেছেন এবং ইমাম যাহাবী হাকেমের কথাতে সহমত পোষণ করেছেন।


[1]. মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ। ইমাম আলবানী (রহি.) এই হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন। দেখুন: সিলসিলা যঈফা, হাদীছ নং- ২১৯৫।

ثانيا: تعليق التمائم – দ্বিতীয়ত: তাবিজ-কবজ ঝুলানো

 

ثالثا: التبرك بالأشجار والأحجار والآثار والبنايات – তৃতীয়ত: গাছ, পাথর, স্মৃতিচি‎হ্ন এবং কবরের উপর নির্মিত প্রাচীর, গ্রীল ইত্যাদি দ্বারা বরকত[1] হাসিল করা

 

رابعا: السحر – চতুর্থত: যাদু করা

 

 

خامسا: الكهانة – পঞ্চমত: ভাগ্য গণনা ও ভবিষ্যদ্বাণী করা

এতেও ইলমুল গায়েবের দাবি করা হয়। যেমন আকাশের কথা চুরি করে শ্রবণকারীর উপর নির্ভর করে যমীনে ভবিষ্যতে যা ঘটবে সে সম্পর্কে খবর দেয়া। জিনেরা চুপেচাপে আসমানের ফেরেশতাদের কথা থেকে মাঝে মাঝে দু’একটি কথা শুনে ফেলে। তারা এ কথাটি গণকের কানে ঢেলে দেয়। গণক তার সাথে একশটি মিথ্যা কথা মিশায়। আর মূর্খ লোকেরা আসমানের ফেরেশতাদের থেকে চুপিসারে জিনদের শ্রুত একটি কথা সত্য হওয়ার কারণে বাকিসব মিথ্যা কথা বিশ্বাস করে।

আল্লাহ তা‘আলা একমাত্র গায়েবের খবর জানেন। সুতরাং যে ব্যক্তি ভবিষ্যৎ বাণী করা কিংবা অন্য কোনোভাবে ইলমুল গায়েবের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার অংশীদার হওয়ার দাবি করলো অথবা ইলমুল গায়েবের দাবিদারকে সত্যায়ন করলো, সে আল্লাহ তা‘আলার খাস বিশেষণের মধ্যে অন্যকে শরীক নির্ধারণ করলো। সেই সঙ্গে সে আল্লাহ তা‘আলা এবং তার রসূলের প্রতি মিথ্যারোপও করলো।

গণক ও ভাগ্য গণনাকারীদের অনেক শয়তানী কাজ-কর্মই শিরক থেকে মুক্ত নয়। ইলমুল গায়েবের দাবি করার জন্য যেসব মাধ্যম যেমন জিন-শয়তান, পাপাত্মা ইত্যাদির সাহায্য নেয়া হয়, তারা ঐসব মাধ্যমের ইবাদতও করে থাকে। সুতরাং ইলমুল গায়েবের দাবি করা, ভাগ্য গণনা করা এবং ভবিষ্যৎ বাণী করা শিরক। কেননা এতে আল্লাহ তা‘আলার খাস ইলমের মধ্যে অংশীদারিত্বের দাবি করা হয়। এদিক থেকে এটি বড় শিরক। সেই সঙ্গে এতে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নৈকিট্য লাভের চেষ্টা করা হয় এবং অন্যের ইবাদতও করা হয়।

সহীহ মুসলিম শরীফে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কতিপয় স্ত্রী থেকে বর্ণিত আছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

مَنْ أَتَى عَرَّافاً فسأله عن شيئ فَصَدَّقَهُ بِمَا يَقُولُ لَمْ تُقْبَلْ لَهُ صَلاَةٌ أَرْبَعِينَ يَوْماً

‘‘যে ব্যক্তি কোনো গণকের কাছে গেল, অতঃপর তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করল এবং গণকের কথাকে সত্য বলে বিশ্বাস করল, চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার নামাজ কবুল হবে না’’।[1]

আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

مَنْ أَتَى كَاهِناً فَصَدَّقَهُ بِمَا يَقُولُ فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ

‘‘যে ব্যক্তি গণকের কাছে আসল, অতঃপর গণক যা বলল তা সত্য বলে বিশ্বাস করল সে মূলত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর যা নাযিল করা হয়েছে তা অস্বীকার করল। ইমাম আবু দাউদ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন’’।[2]

মুসলিমদেরকে যেসব বিষয় থেকে সতর্ক করা আবশ্যক, তার মধ্যে যাদুকর, গণক এবং ভেলকিবাজ, ফাঁকিবাজ ও ধোঁকাবাজদের বিষয়টি অন্যতম। সংশোধন করার বদলে তারা পৃথিবীতে বিপর্যয় ও ফাসাদ সৃষ্টি করে। তাদের কেউ কেউ নিজেকে মানুষের সামনে রোগ-ব্যাধির ডাক্তার হিসাবে প্রকাশ করে। মূলতঃ সে মানুষের ঈমান-আকীদা বরবাদ করে দেয়। কেননা সে রোগীকে আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য হাস-মুরগী-কবুতর, গরু-খাসী ইত্যাদি যবেহ করার আদেশ করে অথবা তার জন্য শিরকী যাদুমন্ত্র, তেলেসমাতি, শয়তানের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা সম্বলিত তাবীয লিখে দেয়।

যাদুকর ও গণকদের আরেকটি শ্রেণী ভবিষ্যৎ বক্তার পোষাকে মানব সমাজে আত্মপ্রকাশ করে। ভাগ্য গণনা করা, গায়েবী বিষয়ের খবর এবং হারানো বস্তুর স্থানের সন্ধান দেয়ার জন্য মূর্খরা তাদের কাছে এসে হারানো বস্তুর স্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। গণকরা তাদেরকে সেটার স্থান সম্পর্কে খবর দেয় অথবা শয়তানের সাহায্যে তাদের হারানো বস্তু এনে দেয়।

তাদের কেউ আবার অলীর আকৃতিতে মানুষের সামনে উপস্থিত হয় এবং অলৌকিক জিনিস এবং কারামত দেখায়। যেমন তারা আগুনে ঝাপ দেয়, অস্ত্র দিয়ে নিজের শরীরে আঘাত করে, সাপ ধরে ইত্যাদি। প্রকৃত পক্ষে এরা মিথ্যুক, ভেলকিবাজ এবং শয়তানের দোসর। এদের প্রত্যেকেই ফন্দিবাজি, ধোঁকাবাজি ও ফাঁকিবাজির মাধ্যমে মানুষের ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করতে চায়। সেই সঙ্গে তারা মানুষের ঈমান- আকীদাও নষ্ট করে।

সুতরাং এদের ধোঁকাবাজি, ফাঁকিবাজি ও ভেলকিবাজি থেকে মুসলিমদের সাবধান থাকা আবশ্যক। তাদের খপ্পরে পড়া থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা জরুরী। মুসলিম শাসকদের উচিত তাদেরকে ধরে তাওবা করানো। তাওবা করলে তো ভালো অন্যথায় এদেরকে হত্যা করা আবশ্যক। এতেই মুসলিমগণ তাদের ক্ষতি, ফিতনা ও ফাসাদ থেকে নিরাপদ থাকবে। সেই সঙ্গে তাদের ব্যাপারে আল্লাহর হুকুমু বাস্তবায়ন হবে।

সহীহ বুখারীতে বাজালা ইবনে আবাদাহ থেকে বর্ণিত আছে, উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু মুসলিম গভর্ণরদের কাছে পাঠানো নির্দেশনামায় লিখেছেন,

أَنِ اقْتُلُوا كُلَّ سَاحِرٍ وَسَاحِرَةٍ قَالَ: فَقَتَلْنَا ثَلاَثَ سَوَاحِرَ

‘‘তোমরা প্রত্যেক যাদুকর পুরুষ এবং যাদুকর নারীকে হত্যা করো। বাজালা বলেন, এ নির্দেশের পর আমরা তিনজন যাদুকর মহিলাকে হত্যা করেছি’’।[3]

জুনদুব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে ‘মারফু’ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

حَدُّ السَّاحِرِ ضَرْبَةٌ بِالسَّيْفِ

‘‘যাদুকরের শাস্তি হচ্ছে তলোয়ারের এক আঘাতে গর্দান উড়িয়ে দেয়া’’।[4] ইমাম তিরমিযী হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।


[1]. সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: গণকের কাজ নিষিদ্ধ এবং গণকের কাছে যাওয়াও নিষিদ্ধ।

[2]. ইমাম আলবানীও হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন, দেখুন: সিলসিলা ছহীহা, হাদীছ নং- ৩৩৮৭।

[3]. সুনানে বায়হাকী, অধ্যায়: যাদুকরকে কাফের বলা এবং তাকে হত্যা করা।

[4]. তিরমযী, অধ্যায়: যাদুকরের শাস্তি। ইমাম আলবানী (রহি.) এই হাদীছকে সহীহ বলেছেনঃ দেখুন: সিলসিলা যঈফা, হাদীছ নং- ১৪৪৬।

 

 

سادسا: التطير – ষষ্ঠত: কোনো কোনো সৃষ্টিকে অশুভ মনে করা

বিভিন্ন পাখি, বিভিন্ন নাম, ভিন্ন শব্দ, বিভিন্ন স্থান, বিভিন্ন লোক এবং অন্যান্য সৃষ্টিকে কুলক্ষণ মনে করাকে التطير বলা হয়। কোনো মানুষ যখন দীন বা দুনিয়ার কোনো কাজের সুদৃঢ় ইচ্ছা করার পর অপছন্দনীয় কিছু দেখে বা শুনে, তাহলে সেটা তার মধ্যে নিম্নোক্ত দু’টি বিষয়ের যে কোনো একটির প্রভাব পড়তে পারে।

(১) সে যা শুনে বা দেখে তাকে কুলক্ষণ মনে করে সেটা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্বীয় ইচ্ছা পুরণ করা থেকে ফিরে আসলে উপরোক্ত অপ্রিয় জিনিস থেকে তার অন্তরে ঢুকে যেতে পারে। কুলক্ষণের এ ধারণা তার ঈমানের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তার তাওহীদের মধ্যে ঘাটতি আসে এবং আল্লাহর উপর ভরসাও কমে যায়।

(২) অথবা সে যদি তার উদ্দেশ্য পুরণ করার জন্য অগ্রসর হওয়া থেকে ফিরে নাও আসে, কিন্তু তার অন্তরে কুলক্ষণের ধারণার কুপ্রভাব থেকেই যায়। সে দুঃশ্চিন্তা, ব্যথা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, শয়তানের কুমন্ত্রণা এবং মানসিক দুর্বলতা নিয়েই কাজের প্রতি অগ্রসর হয়।

সুতরাং কেউ যখন তার অন্তরে কোনো কিছু থেকে অকল্যাণ-অশুভ হওয়ার ধারণা অনুভব করে, তখন সেটা প্রতিরোধ করার পচেষ্টা চালাবে, সেটা ঠেকাতে আল্লাহর নিকট সাহায্য চাইবে, তার উপর ভরসা করবে এবং দৃঢ়তার সাথে স্বীয় উদ্দেশ্য পূরণে অগ্রসর হবে। মোটকথা কেউ যদি অপছন্দনীয় কিছু প্রত্যক্ষ করে তখন যেন বলে,

اللَّهُمَّ لاَ يَأْتِى بِالْحَسَنَاتِ إِلاَّ أَنْتَ وَلاَ يَدْفَعُ السَّيِّئَاتِ إِلاَّ أَنْتَ وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِكَ

‘‘হে আল্লাহ! তুমি ছাড়া অন্য কেউ কল্যাণ দিতে পারে না। তুমি ছাড়া কেউ অকল্যাণ প্রতিহত করতে সক্ষম নয়। তোমার সাহায্য ব্যতীত কেউ অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতে পারে না এবং তোমার তাওফীক ও শক্তি ব্যতীত সৎ আমল করাও সম্ভব নয়।[1]

সৃষ্টি থেকে অশুভ-অকল্যাণ হওয়ার আশঙ্কা করা অতি প্রাচীন একটি ব্যাধি। পূর্বেকার অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ও এমনটি করতো বলে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে উল্লেখ করেছেন। শুধু তাই নয়; আল্লাহ তা‘আলার সর্বোত্তম সৃষ্টি নবী-রসূল ও তাদের মুমিন অনুসারীদের থেকেও তারা অশুভ-অকল্যাণের ধারণা করতো। আল্লাহ তা‘আলা ফেরাআউন ও তার সম্প্রদায় সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন যে, তারা যখন মুছীবতে পড়তো, তখন তারা মূসা এবং তার সঙ্গীদের অশুভ কারণ মনে করতো’’। (সূরা আরাফ: ১৩১)

আল্লাহ তা‘আলা সালেহ আলাইহিস সালামের গোত্র সম্পর্কে বলেন,

﴿قَالُوا اطَّيَّرْنَا بِكَ وَبِمَن مَّعَكَ قَالَ طَائِرُكُمْ عِندَ اللَّهِ بَلْ أَنتُمْ قَوْمٌ تُفْتَنُونَ﴾

‘‘তারা বললো, তোমাকে এবং তোমার সাথীদেরকে আমরা অমঙ্গলের কারণ মনে করি। সালেহ জবাব দিলেন, তোমাদের কল্যাণ-অকল্যাণ আল্লাহর নিকটেই। বস্তুত তোমরা এমন এক সম্প্রদায় যাদেরকে পরীক্ষা করা হচ্ছে’’। (সূরা নামল: ৪৭)

এমনি জনপদবাসীদের ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন যে, তারা আল্লাহর নবী-রসূলদেরকে বলেছিল,

﴿إِنَّا تَطَيَّرْنَا بِكُمْ لَئِن لَّمْ تَنتَهُوا لَنَرْجُمَنَّكُمْ وَلَيَمَسَّنَّكُم مِّنَّا عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾

‘‘ওরা বললো, আমরা তোমাদেরকে অমঙ্গলের কারণ মনে করি। যদি তোমরা বিরত না হও তাহলে অবশ্যই তোমাদেরকে প্রস্তারাঘাতে নিহত করবো এবং আমাদের পক্ষ হতে তোমাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি স্পর্শ করবে’’। (সূরা ইয়াসীন: ১৮)

আল্লাহ তা‘আলা মক্কার মুশরিকদের সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন যে, তারা বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অমঙ্গলের কারণ মনে করতো। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَإِن تُصِبْهُمْ حَسَنَةٌ يَقُولُوا هَٰذِهِ مِنْ عِندِ اللَّهِ وَإِن تُصِبْهُمْ سَيِّئَةٌ يَقُولُوا هَٰذِهِ مِنْ عِندِكَ قُلْ كُلٌّ مِّنْ عِندِ اللَّهِ فَمَالِ هَٰؤُلَاءِ الْقَوْمِ لَا يَكَادُونَ يَفْقَهُونَ حَدِيثًا﴾

‘‘যদি তাদের কোনো কল্যাণ হয় তাহলে তারা বলে, এতো আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়েছে। আর কোনো ক্ষতি হলে বলে, এটা হয়েছে তোমার পক্ষ হতে। বলে দাও, সবকিছুই হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে। লোকদের কী হয়েছে, কোনো কথাই তারা বুঝতে চেষ্টা করে না’’। (সূরা নিসা: ৭৮)

এমনি সকল যুগেই মুশরিকদের দীন একই রকম। তাদের অন্তর ও মন উল্টে গেছে। ফলে যারা কল্যাণের উৎস, তাদেরকেই খারাপ মনে করছে। নবী-রসূলগণ কল্যাণের পথনির্দেশক হওয়া সত্ত্বেও তরা তাদেরকে অকল্যাণের কারণ মনে করেছে। তাদের ভিতরে গোমরাহী চেপে বসা তাদের সৃষ্টিগত স্বভাব নষ্ট হয়ে যওয়ার কারণেই এমনটি হয়েছে। অন্যথায় কল্যাণ-অকল্যাণ উভয়টিই আল্লাহর ফায়ছালা ও নির্ধারণ অনুযায়ী হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলার হিকমত ও ইলম অনুযায়ী উভয়টি হয়ে থাকে। অকল্যাণ হয়ে থাকে তার হিকমতের দাবি অনুসারে এবং কল্যাণ হয়ে থাকে তার অনুগ্রহে। তার অপার অনুগ্রহ এবং আনুগত্যের বিনিময় স্বরূপ তিনি কল্যাণ দান করেন। তার আদল-ইনসাফের কারণেই তার থেকে অকল্যাণ ও পাপাচারের বিনিময় স্বরূপ শাস্তি এসে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مَّا أَصَابَكَ مِنْ حَسَنَةٍ فَمِنَ اللَّهِ وَمَا أَصَابَكَ مِن سَيِّئَةٍ فَمِن نَّفْسِكَ﴾

  ‘‘হে মুহাম্মাদ! যে কল্যাণই তুমি লাভ করে থাকো না কেন, তা আল্লাহর দান এবং যে বিপদ তোমার উপর আপতিত হয় তা তোমার নিকট থেকেই’’।[2] (সূরা আন নিসা: ৭৯)

التطير শিরক হওয়ার আরেকটি কারণ হলো এতে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের প্রতি কল্যাণ-অকল্যাণের সম্বন্ধ করা হয় এবং এমন সৃষ্টি থেকে ক্ষতি হওয়ার আকীদা পোষণ করা হয়, যে নিজেই নিজের কল্যাণ কিংবা ক্ষতি করার মালিক নয়। এটি শিরক হওয়ার আরেকটি কারণ হলো, শয়তানই মানুষের অন্তরে এ ধরণের আকীদা, আশঙ্কা ও কুমন্ত্রণা ঢেলে দেয়। আর শুভাশুভ ও কল্যাণ-অকল্যাণের ধারণা যেহেতু অন্তরের ভয়-ভীতির কারণেই হয়ে থাকে, তাই এটি আল্লাহর উপর ভরসা করার পরিপন্থি।

প্রিয় মুসলিম ভাইগণ! রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম التطير বা কুলক্ষণের ধারণা করা থেকে সতর্ক করতে গিয়ে যা বলেছেন, তা মনোযোগ দিয়ে শুনুন! ইমাম বুখারী আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

لا عَدْوَى وَلا طِيَرَةَ وَلا هَامَةَ وَلا صَفَر

‘‘রোগের কোনো সংক্রমণ শক্তি নেই, পাখি উঁড়িয়ে কল্যাণ-অকল্যাণ নির্ধারণ করারও কোনো ভিত্তি নেই। ‘হামাহ’ তথা হুতুম পেচাঁর ডাক শুনে অশুভ নির্ধারণ করা ভিত্তিহীন। সফর মাসের বিশেষ কোনো প্রভাব নেই’’।[3]

বুখারী ও মুসলিমে আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণিত আছে, রসূল সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

لاَ عَدْوَى وَلاَ طِيَرَةَ وَيُعْجِبُنِى الْفَأْلُ قَالُوا ومَاالفَالُ؟ قال الْكَلِمَةُ الْطَّيِّبَةُ

‘‘সংক্রামক ব্যাধি আর কুলক্ষণ বলতে কিছুই নেই। তবে আমি ‘ফাল’ পছন্দ করি। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ফাল’ কী? তিনি বললেন, ‘উত্তম কথা’।[4]

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে ‘মারফু’ হাদীছে বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:্রالطِّيَرَةُ شِرْكٌ

‘‘তিয়ারাহ’ বা পাখি উঁড়িয়ে ভাগ্য গণনা করা শিরক’’।[5]

সহীহ মুসলিমে মুআবীয়া ইবনুল হাকাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন,

 ومنا أناس يتطيرون؟ فقال: ذلك شيء يجده أحدكم في نفسه فلا يصدنه

‘‘আমাদের মধ্যে কি এমন লোক আছে, যারা কোনো সৃষ্টিকে কুলক্ষণ মনে করে? অতঃপর তিনি বললেন, তোমাদের কেউ যখন তার মনে এ ধরণের কিছু অনুভব করে, তখন এমন ধারণা যেন তাকে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অগ্রসর হতে বাধাগ্রস্থ না করে’’।[6]

এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন, তিয়ারার মাধ্যমে যে লোক কষ্ট পায় এবং যাকে সে কুলক্ষণ মনে করে, এটি তার মন ও আকীদার মধ্যকার ধারণা মাত্র; যে জিনিসকে সে কুলক্ষণ মনে করছে, আসলে তাতে কুলক্ষণ বলতে কিছু নেই। সুতরাং তার ধারণা, ভয়-ভীতি এবং শিরকই কেবল তার মধ্যে কুলক্ষণের ধারণা ঢুকিয়ে দেয় ও তাকে প্রয়োজন পূরণে অগ্রসর হওয়া থেকে বিরত রাখে। ফলে সে অপছন্দনীয় যা দেখে কিংবা শুনে তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রয়োজন পুরণে অগ্রসর হওয়া থেকে ফিরে আসে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার উম্মতের জন্য দীনের সমস্ত বিষয় সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। তিয়ারা বা কোনো কিছু থেকে অকল্যাণ হওয়ার ধারণা সম্পুর্ণ বাতিল হওয়ার কথাও বর্ণনা করেছেন। যাতে তারা জানতে পারে যে, আল্লাহ তা‘আলা কোনো জিনিষের মধ্যেই তাদের জন্য অশুভ রাখেন নি কিংবা তাদের জন্য সেটাতে অকল্যাণের কোনো নির্দেশনা দেন নি অথবা তারা যাকে ভয় করছে করছে তাকে আল্লাহ তা‘আলা ভয়ের কারণ হিসাবেও নির্ধারণ করেন নি।

তিনি সৃষ্টি থেকে অশুভ ও অকল্যাণ হওয়ার ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে নাকোচ করেছেন, যাতে করে আল্লাহ তা‘আলা যে তাওহীদ দিয়ে নবী-রসূলদের পাঠিয়েছেন, যে তাওহীদসহ আসমানী কিতাবসমূহ নাযিল করেছন এবং যার জন্য আসমান-যমীন সৃষ্টি করেছেন, তা বাস্তবায়ন করে মানুষের অন্তর শান্ত হয় এবং তাদের হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে। সুতরাং তিনি তাদের অন্তর থেকে শিরকের মূলোৎপাটন করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তাওহীদের মজবুত হাতলকে আঁকড়ে ধরবে, সেটার শক্ত রশি ধারণ করবে এবং আল্লাহ তা‘আলার উপর ভরসা করবে, তার অন্তরে তিয়ারার ধারণা বদ্ধমূল হওয়ার আগেই সেটা কেটে ফেলতে পারবে এবং সেটা পূর্ণতায় পৌঁছার আগেই মন থেকে তার জল্পনা-কল্পনা উচ্ছেদ করতে পারবে। ইকরিমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

كُنَّا جلوسا عِنْدَ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا فَمَرَّ طائر يَصِيحُ فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الْقَوْمِ: خَيْرٌ خَيْرٌ! فَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: لَا خَيْرَ وَلَا شَرَّ المجالسة وجواهر العلم

‘‘একদা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার নিকট বসা ছিলাম। এ সময় একটি পাখি ডাকাডাকি করতে করতে অতিক্রম করছিল। তখন এক লোক বললো, ভাল হোক! ভালো হোক! আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা তখন বললেন, ভালো বা খারাপ কোনটাই না হোক।

ইবনে আব্বাস তাদের কথার দ্রুত প্রতিবাদ করলেন। যাতে করে কল্যাণ ও অকল্যাণের ব্যাপারে ঐ পাখির কোনো প্রভাব আছে বলে বিশ্বাস না করা হয়। সমস্ত মাখলুকের ক্ষেত্রে কথা একই। কোনো মাখলুকই মানুষের জন্য কল্যাণ আনয়ন করতে পারে না কিংবা অকল্যাণ প্রতিরোধ করতে পারে না।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, وَيُعْجِبُنِى الْفَأْلُ ‘‘তবে আমি ‘ফাল’ পছন্দ করি’’ (সহীহ বুখারী ৫৭৫৬)। অতঃপর ফালের ব্যাখ্যায় বললেন যে, সেটা হলো উত্তম কথা। ফালকে পছন্দ করার কারণ হলো, তাতে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করা হয়। আর বান্দাকে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করার আদেশ দেয়া হয়েছে। আর তিয়ারার মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করা হয় এবং বালা-মুছীবতের কারণ মনে করা হয়। এ জন্যই উভয়ের হুকুমের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কেননা মানুষ যখন আল্লাহ তা‘আলার তরফ থেকে কল্যাণের আশা করবে, তখন অন্তর দিয়ে তার সাথে সম্পর্ক কায়েম করবে এবং তার উপরই ভরসা করবে। আর যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার উপর আশা-ভরসা ছেড়ে দিবে, তখন ইহাই তাদেরকে শিরক এবং আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের উপর ভরসা করার দিকে নিয়ে যাবে।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, ফাল পছন্দ করা ও সেটাকে ভালোবাসার মধ্যে শিরকের কিছু নেই; বরং এটি মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাবের দাবির বহিঃপ্রকাশ মাত্র। সেই সঙ্গে এটি মানুষের ফিতরাতেরও দাবি, যা সবসময় তার অনুকূল ও উপযোগী জিনিষের দিকে ধাবিত হয়। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদেরকে সংবাদ দিয়েছেন যে, দুনিয়ার ভোগ-সামগ্রী থেকে তার কাছে নারী ও সুঘ্রাণ সর্বাধিক পছন্দনীয় করে দেয়া হয়েছে। তিনি মিষ্টি ও মধুও পছন্দ করতেন। তিনি সুন্দর কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত এবং মধুর সুরে আযান দেয়া পছন্দ করতেন। তিনি উত্তম চারিত্রিক গুণাবলী এবং সুমহান বৈশিষ্ট্যগুলো পছন্দ করতেন।

মোটকথা, তিনি পূর্ণতার গুণাবলী পছন্দ করতেন। এমনি যেসব বৈশিষ্ট মানুষকে কল্যাণের দিকে নিয়ে যায় তিনি তাও পছন্দ করতেন। আল্লাহ তা‘আলা মানুষের সৃষ্টিগত বৈশিষ্টের মধ্যে ভালো নাম শুনে খুশি হওয়া, ভালো নাম পছন্দ করা এবং ভালো নামের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার স্বভাব স্থাপন করেছেন।

মানুষ الفلاح ‘ফালাহ’ (সফলতা), السلام ‘সালাম’ (শান্তি-নিরাপত্তা), النجاح ‘নাজাহ’ (কৃতকার্যতা) التهنئة ‘তাহনিআহ’ (মুবারকবাদ), البشرى ‘বুশরাহ’ (সুখবর), الفوز ফাউয, (বিজয়), الظفر যাফ্র (ধন্য হওয়া) ইত্যাদি নাম শুনে খুশী হয় এবং আন্তরিক প্রশান্তি লাভ করে। এ শব্দগুলো উচ্চারণের আওয়াজ মানুষের কানে পৌঁছার সাথে সাথেই তার অন্তর খুশি হয়, বক্ষ প্রশস্ত হয় এবং হৃদয় শক্তিশালী হয়। আর যখন এগুলোর বিপরীত শুনে, তখন তার অন্তরে বিপরীত অবস্থা সৃষ্টি হয় এবং সেটাকে চিন্তিত করে তুলে এবং তাতে ভয়-ভীতি, অশুভ ধারণা, সংকোচন, বিষন্নতা ইত্যাদির সৃষ্টি করে। ফলে সে তার প্রয়োজন পুরণের ইচ্ছা পরিহার করে এবং ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তার ঈমানে ঘাটতি আসে এবং কখনো শিরকের লিপ্ত হয়। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের কথা এখানেই শেষ।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণনা করেছেন যে,

مَنْ رَدَّتْهُ الطِّيَرَةُ مِنْ حَاجَةٍ فَقَدْ أَشْرَكَ

‘‘কুলক্ষণের ধারণা যাকে প্রয়োজন পুরণে বাধা দিল সে শিরক করল। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, এর কাফ্ফারা কী? উত্তরে তিনি বললেন, তোমরা এ দু‘আ পড়বে,

اللَّهُمَّ لَا خَيْرَ إِلَّا خَيْرُك وَلَا طَيْرَ إِلَّا طَيْرُك وَلَا إِلَهَ غَيْرُك

‘‘হে আল্লাহ! তোমার কল্যাণ ব্যতীত অন্য কোনো কল্যাণ নেই। তোমার অমঙ্গল ছাড়া কোনো অমঙ্গল নেই।[7] আর তুমি ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই’’।[8]

সুতরাং এ হাদীছ শরীফ থেকে জানা যাচ্ছে যে, যে তিয়ারাকে অপছন্দ করে এবং আপন কাজে দৃঢ়তার সাথে অগ্রসর হয় সেটা তার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু যে এখলাসের সাথে আল্লাহর উপর ভরসা করে না; বরং শয়তানের পথে চলে, সে অপছন্দনীয় কাজের শিকার হয়। কেননা সে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমানের দাবি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো।

তিয়ারা সম্পর্কে উপরোক্ত আলোচনাটি ভালোভাবে বুঝা উচিত। আমরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে তার প্রতি পূর্ণ ঈমান ও তার উপর পরিপূর্ণ ভরসা দান করেন এবং অকল্যাণের সকল পথ ও শিরক থেকে আমাদেরকে উদ্ধার করেন। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা এবং সাড়াদানকারী।


[1]. আবু দাউদ, অধ্যায়: তিয়ারাহ। ইমাম আলবানী (রহি.) এই হাদীছকে সহীহ বলেছেন। দেখুন: সিলসিলা ছহীহা, হাদীছ নং- ১৬১৯।

[2]. কল্যাণ-অকল্যাণ উভয়ই আল্লাহর পক্ষ হতে। কিন্তু এরা নিজেদের বিবেক-বুদ্ধির স্বল্পতা, মূর্খতা এবং যুলুম-অত্যাচারের আধিক্যের কারণে তা বুঝে না। আর এখানে অকল্যাণকে বান্দার প্রতি সম্বন্ধ করার কারণ হলো বান্দার ভুলের কারণেই শাস্তি স্বরূপ আল্লাহ সেটা তার উপর নির্ধারণ করেন।

[3]. সহীহ বুখারী ৫৭০৭, অধ্যায়: কুষ্ঠরোগ, ইবনে মাজাহ ৩৫৩৯।

[4]. সহীহ মুসলিম ২২২৪।

[5]. সহীহ: ইবনে মাজাহ ৩৫৩৮, আবূ দাউদ ৩৯১০।

[6]. সহীহ মুসলিম ৫৩৭।

[7]. প্রাচীন আরবদের মধ্যে একটি বদ অভ্যাস ছিল যে, তারা যখন সফরে বের হত অথবা কোন প্রয়োজন পুরণের জন্য ঘর থেকে বের হত, তখন পাখি উড়িয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করতো এবং যাত্রা শুভ হবে কি না তা যাচাই করত। পাখিটি যদি ডান দিকে উড়ে যেত, তাহলে তারা শুভ লক্ষণ মনে করত এবং যাত্রা অব্যাহত রাখত। আর যদি পাখি বাম দিকে উড়ে যেত, তাহলে কুলক্ষণ মনে করত এবং সফরে অমঙ্গল হবে মনে করে বাড়ীতে ফিরে আসত। এই কাজকে তিয়ারা বলা হয়। ‘তিয়ারাহ’ শব্দটি طير থেকে। طير অর্থ পাখি। পাখি উড়িয়ে যেহেতু তারা ভাগ্য পরীক্ষা করতো, তাই তাদের এই কাজকে তিয়ারাহ বলা হয়েছে। পরবর্তীতে যে কোনো বস্তুর মাধ্যমে শুভ-অশুভ নির্ধারণ করার প্রচেষ্টাকেই তিয়ারা হিসাবে নাম করণ করা হয়েছে। ইসলাম এই ধারণার মূলোৎপাটন করেছে। ইসলাম সুস্পষ্ট ঘোষণা করেছে যে, পাখির ডান দিকে অথবা বাম দিকে চলাচলের মধ্যে কোনো কল্যাণ বা অকল্যাণ নেই। কল্যাণ এবং অকল্যাণের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।

[8]. মুসনাদে আহমাদ। ইমাম আলবানী (রহি.) হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুন: হাদীছ নং- ১০৬৫।

 

سابعا: التنجيم – সপ্তমত: জ্যোতির্বিদ্যা

 

ثامنا: الاستسقاء بالأنواء – অষ্টমত: তারকার মাধ্যমে বৃষ্টি কামনা করা

তারকা উদিত হওয়া কিংবা অস্ত যাওয়ার দিকে বৃষ্টি বর্ষণের সম্বন্ধ করাকে, الاستسقاء بالأنواء বলা হয়। অন্ধকার যুগের মুশরিকরা বিশ্বাস করতো যে, তারকা উদিত হওয়া কিংবা অদৃশ্য হওয়ার কারণে বৃষ্টি হয়। তারা বলতো, ‘অমুক অমুক নক্ষত্রের কারণে আমরা বৃষ্টিপ্রাপ্ত হয়েছি। نوء শব্দের মাধ্যমে তারা তারকা উদ্দেশ্য করতো। তারকাকে তারা نوء দ্বারা ব্যাখ্যা করতো। মূলত এর অর্থ হলো তারকা উদিত হওয়া। যেমন বলা হয় ناء ينوء উদিত হলো। এ কথা ঠিক ঐ সময় বলা হয়, যখন উঠে দাঁড়ায় এবং ছুটে যায়। তারা বলতো, যখন অমুক তারকা উদিত হবে, তখন বৃষ্টি হবে।

আরবরা أنواء দ্বারা চন্দ্রের ২৮টি মঞ্জিল উদ্দেশ্য করতো। প্রত্যেক তের রাতে ফজরের সময় একটি করে মঞ্জিল লোপ পায় এবং তার বদলে আরেকটি উদিত হয়। চন্দ্র বছরের শেষে সবগুলো নিঃশেষ হয়ে যায়। জাহেলী যুগে আরবরা ধারণা করতো ফজরের সময় যখন একটি উদিত হয় এবং অন্য একটি অস্ত যায়, তখনই বৃষ্টি হয়। একেই তারা বলতো, তারকার মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করা। এর অর্থ হলো তারা বৃষ্টিকে এসব উদীয়মান তারকার প্রতি সম্বন্ধ করতো। এটি ছিল জাহেলী যুগের আরবদের বিশ্বাস। ইসলাম এসে এ বিশ্বাসকে বাতিল করে দিয়েছে এবং তা থেকে নিষেধ করেছে। কেননা বৃষ্টি অবতীর্ণ হওয়া কিংবা না হওয়ার বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা, নির্ধারণ ও হিকমতের উপর নির্ভরশীল। এতে তারকা উদয়ের কোনো প্রভাব নেই।

আল্লাহ তা‘আলা আয়াতগুলো নাযিল করেন,

﴿فَلَا أُقْسِمُ بِمَوَاقِعِ النُّجُومِ (৭৫) وَإِنَّهُ لَقَسَمٌ لَوْ تَعْلَمُونَ عَظِيمٌ إِنَّهُ لَقُرْآَنٌ كَرِيمٌ (৭৭) فِي كِتَابٍ مَكْنُونٍ (৭৮) لَا يَمَسُّهُ إِلَّا الْمُطَهَّرُونَ (৭৯) تَنْزِيلٌ مِنْ رَبِّ الْعَالَمِينَ (৮০) أَفَبِهَذَا الْحَدِيثِ أَنْتُمْ مُدْهِنُونَ (৮১) وَتَجْعَلُونَ رِزْقَكُمْ أَنَّكُمْ تُكَذِّبُونَ﴾

‘‘অতএব, আমি তারকারাজির ভ্রমণ পথের শপথ করছি, নিশ্চয় এটি বড় শপথ যদি তোমরা জানতে পারো। নিশ্চয় এটা সম্মানিত কুরআন, যা সুরক্ষিত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। পবিত্রগণ ব্যতীত অন্য কেউ একে স্পর্শ করতে পারে না। এটি বিশ্ব পালনকর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। তবুও কি তোমরা এ বাণীর প্রতি শৈথিল্য প্রদর্শন করছো? এ নিয়ামতে তোমরা নিজেদের অংশ এই রেখেছো যে, তোমরা তা অস্বীকার করছো। (সূরা ওয়াকিয়া: ৭৫-৮২)

আল্লাহ তা‘আলার বাণী, ‘‘এ নেয়ামতে তোমরা নিজেদের অংশ এ রেখেছো যে, তোমরা তা অস্বীকার করছো’’ -এর অর্থ হলো আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে অবতীর্ণ বৃষ্টির সম্বন্ধ তারকার দিকে এভাবে করা যে, مطرنا بنوء كذا وكذا আমরা অমুক অমুক তারকার কারণে বৃষ্টিপ্রাপ্ত হয়েছি। এটি সর্ববৃহৎ মিথ্যা ও অপবাদের অন্তর্ভুক্ত।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল, তিরমিযী হাসান সূত্রে, ইবনে জারীর, আবু হাতিম এবং ইমাম যিয়াউদ্দীন মাকদেসী স্বীয় কিতাব মুখতারায় আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর বাণী,تجعلون رزقكم তোমাদের নিয়ামতের অংশকে অর্থাৎ আল্লাহর শুকরিয়াকে তোমরা এই করেছ যে, তোমরা মিথ্যা প্রতিপন্ন করছো। তোমরা বলে থাক যে, অমুক অমুক তারকার কারণে আমরা বৃষ্টিপ্রাপ্ত হয়েছি।

শাইখ আব্দুর রাহমান ইবনে হাসান রহিমাহুল্লাহ বলেন, উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় যা বলা হয়েছে, তাই সর্বোত্তম ব্যাখ্যা। আলী, ইবনে আব্বাস, কাতাদাহ, যাহ্হাক, আতা আল-খোরাসানী এবং অন্যান্য আলেম থেকে উপরোক্ত ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে। এটিই অধিকাংশ মুফাস্সিরের মতো। শাইখ আব্দুর রাহমান ইবনে হাসানের কথা এখানেই শেষ।

আবু মালেক আশআরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

أَرْبَعٌ فِى أُمَّتِى مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ لاَ يَتْرُكُونَهُنَّ الْفَخْرُ فِى الأَحْسَابِ وَالطَّعْنُ فِى الأَنْسَابِ وَالاِسْتِسْقَاءُ بِالنُّجُومِ وَالنِّيَاحَةُ وَقَالَ النَّائِحَةُ إِذَا لَمْ تَتُبْ قَبْلَ مَوْتِهَا تُقَامُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَعَلَيْهَا سِرْبَالٌ مِنْ قَطِرَانٍ وَدِرْعٌ مِنْ جَرَبٍ

 ‘‘জাহেলী যুগের চারটি কু-স্বভাব আমার উম্মতের মধ্যে বিদ্যমান থাকবে, যা তারা পুরোপুরি পরিত্যাগ করতে পারবে না। (এক) আভিজাত্যের অহংকার করা। (দুই) বংশের বদনাম করা। (তিন) নক্ষত্ররাজির মাধ্যমে বৃষ্টি কামনা করা এবং (চার) মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করা। তিনি আরও বলেন, ‘মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপকারিনী মৃত্যুর পূর্বে যদি তাওবা না করে, তাহলে কিয়ামতের দিন তাকে এমন অবস্থায় উঠানো হবে যে, তার পরনে থাকবে আলকাতরার প্রলেপযুক্ত লম্বা পায়জামা এবং খোস-পাঁচড়াযুক্ত কোর্তা।[1]

জাহেলী যুগ বলতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বের যুগ উদ্দেশ্য। তার আনীত দীনের পরিপন্থী প্রত্যেক বিষয়ই জাহেলীয়াতের অন্তর্ভুক্ত।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহ এ হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন যে, মানুষ জাহেলীয়াতের কতক স্বভাব ছাড়তে পারবে না। যারা তা ছাড়তে পারবে না, তাদের নিন্দাবাদ বর্ণনা করতে গিয়েই তিনি এ কথা বলেছেন। হাদীছের দাবি হলো, জাহেলীয়াতের প্রত্যেক কথা ও কাজই দীন ইসলামের মধ্যে নিন্দিত। তা না হলে এগুলোকে জাহেলীয়াতের দিকে সম্বন্ধ করে নিন্দা করা হতোনা। সুতরাং জানা গেলো, নিন্দা করণার্থেই উপরোক্ত কাজগুলোর সম্বন্ধ জাহেলীয়াতের দিকে করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى﴾

 ‘‘তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে। মূর্খতা যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না’’। (সূরা আল আহযাব: ৩৩)

এখানে জাহেলী যামানার নারীদের সৌন্দর্য্য প্রদর্শন করে বের হওয়ার নিন্দা করা হয়েছে এবং জাহেলী যুগের লোকদেরও নিন্দা করা হয়েছে। এ নিন্দার দাবী হচ্ছে জাহেলী যুগের লোকদের সাদৃশ্য করা নিষিদ্ধ। শাইখুল ইসলামের বক্তব্য এখানেই শেষ।

الاستسقاء بالأنواء তারকাজির মাধ্যমে বৃষ্টি কামনা করা: এর অর্থ হলো তারকার দিকে বৃষ্টির সম্বন্ধ করা। نوء অর্থ হলো তারকা অস্তমিত হওয়া। যেমন কোনো মানুষ বললো, আমরা অমুক অমুক তারকা অস্তমিত হওয়ার মাধ্যমে বৃষ্টিপ্রাপ্ত হয়েছি।

الاستسقاء بالأنواء তারকাজির মাধ্যমে বৃষ্টি কামনা করার হুকুম: যদি বিশ্বাস করা হয় যে, বৃষ্টি বর্ষণে নক্ষত্রের প্রভাব রয়েছে তাহলে এমন বিশ্বাস কুফুরী ও বড় শিরক। জাহেলী যামানার মুশরিকরা এ বিশ্বাসই করতো। আর যদি বিশ্বাস করা হয় যে, বৃষ্টি বর্ষণে তারকার নিজস্ব কোনো প্রভাব নেই; বরং আল্লাহই একমাত্র বৃষ্টি বর্ষণকারী, তবে আল্লাহ তা‘আলা একটি নিয়ম করেছেন যে, অমুক তারকা অস্তমিত হবার সময় বৃষ্টি হবেই তাহলে এ বিশ্বাস বড় শিরক পর্যন্ত পৌঁছবে না। কিন্তু ছোট শিরকের পর্যায়ে পড়বে। কেননা তারকার দিকে বৃষ্টি বর্ষণের সম্বন্ধ করা হারাম। শিরকের দরজা বন্ধ করণার্থে রূপকার্থেও এটি নিষিদ্ধ।

ইমাম বুখারী ও মুসলিম যায়েদ ইবনে খালেদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন,

صَلَّى لَنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم صَلاَةَ الصُّبْحِ بِالْحُدَيْبِيَةِ عَلَى إِثْرِ سَمَاءٍ كَانَتْ مِنَ اللَّيْلَةِ  فَلَمَّا انْصَرَفَ أَقْبَلَ عَلَى النَّاسِ فَقَال্َর هَلْ تَدْرُونَ مَاذَا قَالَ رَبُّكُمْ  قَالُوا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ  قَال্َর أَصْبَحَ مِنْ عِبَادِى مُؤْمِنٌ بِى وَكَافِرٌ فَأَمَّا مَنْ قَالَ مُطِرْنَا بِفَضْلِ اللَّهِ وَرَحْمَتِهِ فَذَلِكَ مُؤْمِنٌ بِى وَكَافِرٌ بِالْكَوْكَبِ وَأَمَّا مَنْ قَالَ بِنَوْءِ كَذَا وَكَذَا فَذَلِكَ كَافِرٌ بِى وَمُؤْمِنٌ بِالْكَوْكَبِ

‘‘রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুদাইবিয়াতে আমাদেরকে নিয়ে ফজরের নামাজ পড়লেন। সে রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। সালাত শেষে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদের দিকে ফিরে বললেন, তোমরা কি জানো তোমাদের প্রভু আজ রাতে কী বলেছেন? লোকেরা বললো আল্লাহ ও তার রসূলই অধিক জানেন। তিনি বললেন, আল্লাহ বলেছেন, আজ সকালে আমার বান্দাদের মধ্যে কেউ আমার প্রতি ঈমানদার হয়েছে আবার কেউ কাফের হয়েছে। যে ব্যক্তি বলেছে, ‘আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে বৃষ্টি হয়েছে, সে আমার প্রতি ঈমান এনেছে আর বৃষ্টি বর্ষণে নক্ষত্রের প্রভাবকে অস্বীকার করেছে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি বলেছে, ‘অমুক অমুক নক্ষত্রের কারণে বৃষ্টিপাত হয়েছে, সে আমাকে অস্বীকার করেছে আর নক্ষত্রের প্রতি ঈমান এনেছে’’।[2]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উক্তি, আল্লাহ বলেছেন, আজ সকালে আমার বান্দাদের মধ্যে কেউ আমার প্রতি ঈমানদার হয়েছে আবার কেউ কাফের হয়েছে। এখানে মুমিনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি বৃষ্টি বর্ষণকে আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতের দিকে সম্বন্ধ করে, সে মুমিন। আর যে বৃষ্টিকে তারকার দিকে সম্বন্ধ করে তাকে কাফের হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। এতে দলীল পাওয়া যাচ্ছে যে, আল্লাহর কাজকে অন্যের দিকে সম্বন্ধ করা জায়েয নয়। এটি নিঃসন্দেহে কুফুরী। মানুষ যদি বিশ্বাস করে, বৃষ্টি বর্ষণে তারকার প্রভাব রয়েছে, তাহলে এটি বড় কুফুরী। কেননা এতে আল্লাহর রুবুবীয়াতে শিরক করা হয়। মুশরিকও কাফেরের অন্তর্ভুক্ত।

আর যদি বিশ্বাস করা হয় যে, বৃষ্টি বর্ষণে তারকার কোনো প্রভাব ও ক্ষমতা নেই, বৃষ্টিকে তারকার দিকে কেবল রূপকার্থে সম্বন্ধ করা হয়েছে, তাহলে এটিও হারাম হবে এবং ছোট শিরকের অন্তর্ভুক্ত হবে। কেননা সে আল্লাহর দেয়া নিয়ামতের সম্বন্ধ অন্যের দিকে করেছে।

ইমাম কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, পূর্বাকাশে যখন একটি তারকা উদিত হতো এবং পশ্চিমাকাশে অন্য একটি তারকা অস্তমিত হতো, তখন বৃষ্টিপাত হলে কিংবা বাতাস প্রবাহিত হলে প্রাচীন আরবদের কেউ কেউ উদিত তারকার দিকে আবার কেউ কেউ অস্তমিত তারকার দিকে বৃষ্টিপাতের সম্বন্ধ করতো। এভাবে সম্বন্ধ করতো যে, এগুলোই বৃষ্টি তৈরী, উদ্ভাবন ও বর্ষণ করে। তারা হাদীছে উল্লেখিত কথাটি ব্যবহার করে থাকে। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপরোক্ত বাক্য প্রয়োগ করতে নিষেধ করেছেন। যাতে করে কেউ জাহেলী যুগের লোকদের অনুরূপ আকীদা পোষণ না করে এবং কথা-বার্তায় তাদের সাদৃশ্য গ্রহণ না করে। ইমাম কুরতুবীর বক্তব্য এখানেই শেষ।

ইমাম মুসলিম আল্লাহ তা‘আলার বাণী উল্লেখ করে বলেন:

 ﴿فَلَا أُقْسِمُ بِمَوَاقِعِ النُّجُومِ (৭৫) وَإِنَّهُ لَقَسَمٌ لَوْ تَعْلَمُونَ عَظِيمٌ إِنَّهُ لَقُرْآَنٌ كَرِيمٌ (৭৭) فِي كِتَابٍ مَكْنُونٍ (৭৮) لَا يَمَسُّهُ إِلَّا الْمُطَهَّرُونَ (৭৯) تَنْزِيلٌ مِنْ رَبِّ الْعَالَمِينَ (৮০) أَفَبِهَذَا الْحَدِيثِ أَنْتُمْ مُدْهِنُونَ (৮১) وَتَجْعَلُونَ رِزْقَكُمْ أَنَّكُمْ تُكَذِّبُونَ﴾

‘‘অতএব, আমি তারকারাজির ভ্রমণ পথের শপথ করছি, নিশ্চয় এটি বড় শপথ যদি তোমরা জানতে পারো। নিশ্চয়ই এটা সম্মানিত কুরআন, যা সুরক্ষিত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। পবিত্রগণ ব্যতীত অন্য কেউ একে স্পর্শ করতে পারে না। এটি বিশ্ব পালনকর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। তবুও কি তোমরা এই বাণীর প্রতি শৈথিল্য প্রদর্শন করছো? এ নেয়ামতে তোমরা নিজেদের অংশ এ রেখেছো যে, তোমরা তা অস্বীকার করছো। (সূরা ওয়াকিয়া: ৭৫-৮২)

এ আয়াতগুলোর শানে নুযুল সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাসের বরাত দিয়ে বলেন, কেউ কেউ বলেছেন, অমুক অমুক তারকার প্রভাব সত্য হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা উপরোক্ত আয়াতগুলো নাযিল করেন।

সুতরাং বৃষ্টি বর্ষণ করা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর কাজ, তার শক্তি ও ক্ষমতাধীন। এতে কোনো সৃষ্টির প্রভাব নেই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أَفَرَأَيْتُمُ الْمَاءَ الَّذِي تَشْرَبُونَ أَأَنتُمْ أَنزَلْتُمُوهُ مِنَ الْمُزْنِ أَمْ نَحْنُ الْمُنزِلُونَ﴾

‘‘তোমরা যে পানি পান কর, সে সম্পর্কে তোমরা চিন্তা করেছো কি? তোমরা কি তা মেঘ হতে বর্ষণ কর, না আমি বর্ষণ করি?’’ (সূরা ওয়াকিয়া: ৬৮-৬৯)

সুতরাং যে ব্যক্তি তারকাসমূহ কিংবা প্রাকৃতিক কারণ যেমন পৃথিবীর পরিবেশগত কারণ ও বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে মেঘ সৃষ্টি হয় বলে ধারণা করে তারা মিথ্যা বলে এবং অপবাদ রটায়। এসব ধারণা বড় শিরক। আর যদি বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তা‘আলাই বৃষ্টি বর্ষণকারী, কিন্তু রূপকার্থে বৃষ্টির সম্বন্ধ এগুলোর প্রতি করে, তাহলে এটিও হারাম এবং ছোট কুফুরী। কেননা এতেও আল্লাহ ছাড়া অন্যের দিকে নিয়ামতের সম্বন্ধ করা হয়। যেমন কেউ কেউ বলে থাকে অমুক অমুক তারকার মাধ্যমে আমরা বৃষ্টিপ্রাপ্ত হয়েছি।

এ বিষয়ে কতক সাংবাদিক এবং মিডিয়া কর্মীদের যথেষ্ট  শৈথিল্য প্রদর্শন করতে দেখা যায়। মুসলিমদের এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিত। আল্লাহ তা‘আলাই তাওফীক দানকারী।


[1]. সহীহ মুসলিম ৯৩৪, অধ্যায়: বিলাপ করার ভয়াবহতা।

[2]. সহীহ বুখারী ৮৪৬, অধ্যায়: হুদায়বিয়ার যুদ্ধ।

 

 

تاسعا: نسبة النعم إلى غير الله – নবম: আল্লাহ ব্যতীত অন্যের দিকে নিয়ামতের সম্বন্ধ করা

 

 

Leave a Comment